রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:০৩ অপরাহ্ন
আমার সুরমা ডটকম: চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর কুলখানিতে পায়ের চাপে পিষ্ট হয়ে ১০ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরো অন্তত অর্ধশতাধিক। চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নুরুল হুদা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
সোমবার দুপুর ১ টার দিকে নগরীর জামালখান রোডের রিমা কনভেনশন সেন্টারে এ দুর্ঘটনা ঘটে। সেখানে দুপুর ১টার পর প্রচণ্ড ভিড় তৈরি হয়। খাবার নেওয়াকে কেন্দ্র করে হুড়োহুড়ির একপর্যায়ে এ ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
আজ ১৩টি কমিউনিটি সেন্টারসহ মোট ১৪টি স্থানে মহিউদ্দিন চৌধুরীর কুলখানির আয়োজন করা হয়েছে। এর মধ্যে রীমা কমিউনিটি সেন্টারে হিন্দু-বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীসহ অমুসলিমের জন্য মেজবানের ব্যবস্থা করা হয়।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক মো. আলাউদ্দিন জানান, এখন পর্যন্ত ৯ জনের লাশ হাসপাতালে এসেছে। তবে নিহতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এ ঘটনার খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে গেছেন মহিউদ্দিন চৌধুরীর বড় ছেলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক চৌধুরী মহিবুল হাসান নওফেল।
মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুতে মহানগর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নগরীর মুসাফিরখানা মসজিদে রবিবার আসরের পর দোয়া এবং মঙ্গলবার পর্যন্ত তিন দিন নগরীর প্রতি ওয়ার্ডে আলোচনাসভা ও দোয়ার আয়োজন করা হয়। এর মধ্যে সকাল থেকে মোট ১৪টি স্থানে একযোগে খতমে কোরআন ও মিলাদ মাহফিল চলছে।
উল্লেখ্য গত বৃহস্পতিবার দিবাগত ভোররাতে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বন্দরনগরীর এই প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। তিনবার নির্বাচিত এই মেয়রের মৃত্যুতে চট্টগ্রামের রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সব স্তরের মানুষের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে।
কীভাবে মানুষ মনে রাখবে মহিউদ্দিন চৌধুরীকে
মরহুম আওয়ামী লীগ নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী একেবারে তৃণমূল থেকে উঠে এসে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার অবস্থান গড়ে তুলেছিলেন।
বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র এবং আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী এ কারণেই তিনি মানুষের আস্থা অর্জন করতে সফল হয়েছিলেন বলে বলছিলেন তার রাজনৈতিক সহকর্মীরা।
চৌধুরীর জানাজায় শুক্রবার হাজার হাজার মানুষ অংশ নিয়েছেন।
কিডনিসহ বিভিন্ন জটিলতায় দীর্ঘদিন ভোগার পর শুক্রবার ভোররাতে চট্টগ্রামের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা গেছেন।
ষাটের দশকে চট্টগ্রাম সিটি কলেজের ছাত্র থাকাকালীন সক্রিয় রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন মহিউদ্দিন চৌধুরী। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির মধ্যে দিয়ে যুক্ত হন ছাত্রলীগের সাথে।
তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। সেসময় তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে একবার গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। শেষপর্যন্ত সেখান থেকে পালিয়ে ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।
তার ঘনিষ্ঠজন ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা জামাল হোসেন বলেন তিনি দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের ভেতর দিয়ে এপর্যায়ে এসেছেন।
‘তিনি শ্রমজীবি মানুষের সাথে রাজনীতি করেছেন। তিনি সিটি কলেজের ছাত্র থাকার সময় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। শ্রমিক সংগঠন ও ছাত্র সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। মেয়র থাকাকালীন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার বেডরুম পর্যন্ত সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ছিল। ৯৬-এ তিনি একবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। মুহুর্তের মধ্যে সারা চট্টগ্রামের মানুষ রাস্তায় নেমে পড়েছিল। প্রশাসন ভেঙে পড়েছিল।’
মুক্তিযুদ্ধের পর শ্রমিক রাজনীতির সাথে যুক্ত হন মহিউদ্দিন চৌধুরী। চট্টগ্রামের সাংবাদিক আবুল মোমেন বলেন রাজনীতির পাশাপাশি মহিউদ্দিন চৌধুরী বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, যার মধ্যে দিয়ে তার একটা বাড়তি পরিচয় গড়ে উঠেছিল।
‘যখনই মানুষ দুঃখ দুর্দশার মধ্যে পড়েছে, তিনি কখনো মানুষকে ফেলে যাননি। ১৯৯১ এর সাইক্লোনের সময় বাড়িঘর হারা মানুষকে শহরে তুলে এনে সেবা করেছেন। এটা তার একটা টার্নিং পয়েন্ট।’
‘দ্বিতীয় একটা ঘটনা হলো তিনি যখন চট্টগ্রাম শহরের মেয়র তখন ভূমিকম্পে শহরের একটি দালানের নিচে ৬-৭ জন চ্যাপ্টা হয়ে মারা যায়। তখন ডোমরা পর্যন্ত দুর্গন্ধের কারণে এগুলোর কাছে যেতে চাইছিল না। মহিউদ্দিন চৌধুরী অবলীলায় সেই লাশগুলো তুলে আনেন ও তাদের দাফনের ব্যবস্থা করেন। আন্দোলন সংগ্রামেও মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি লড়াই করেছেন। এজন্য মানুষের আস্থা অর্জন করেছিলেন তিনি,’ বলছিলেন আবুল মোমেন।
মহিউদ্দিন চৌধুরী শুধু চট্টগ্রামে নয় পুরো বাংলাদেশের মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন ১৯৯৪ সালে, যখন তিনি প্রথমবারের মত চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। সেসময় তার সাথে ওয়ার্ড কমিশনার নির্বাচিত হয়েছিলেন মঞ্জুর আলম, যিনি পরবর্তীতে বিএনপিতে যোগ দিয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হয়েছিলেন। মঞ্জুর আলমের দৃষ্টিতে মহিউদ্দিন চৌধুরী রাজনীতির পাশাপাশি মেয়র হিসেবেও সাফল্য দেখিয়েছেন।
‘ওঁনার মেধা দিয়ে কাঙ্খিত উন্নয়নের লক্ষ্যে উনি অনেককিছু করতে চেষ্টা করেছিলেন, কিছুটা সফলও হয়েছেন। বেসিক সেক্টরে, স্বাস্থ্য সেবাকে তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে। একজন সফল মেয়র ছিলেন তিনি। আর গণমানুষের নেতা ছিলেন। যখনই সাধারণ মানুষের অধিকার হরণ হয়েছে, তিনি তাৎক্ষণিকভাবে তার প্রতিবাদ করেছেন।’
১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রায় সপরিবারে হত্যার ঘটনা মহিউদ্দিন চৌধুরীর ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল বলে মনে করেন আবুল মোমেন । তিনি বলছেন সেই ঘটনার প্রতিবাদে মি: চৌধুরী সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টাও করেছিলেন। আবুল মোমেন বলছেন, মহিউদ্দিন চৌধুরী তার নিজের চিন্তা প্রকাশ করার জন্য অনেক সময় নিজের দলের সিদ্ধান্তের বিপক্ষেও গিয়েছেন এবং ফলে তাকে বিতর্কের মুখেও পড়তে হয়েছে।
‘যখন একটা বিষয় তিনি উপলব্ধি করতেন যে এটা জনগণের কল্যাণের কাজ, তখন তিনি কাজটা হাতে তুলে নিতেন। কোন কাজ তাঁর দলের কেউ কেউ হয়তো পছন্দ করেনি, কিন্তু তিনি তার তোয়াক্কা করেননি। বৃহত্তর জনস্বার্থে তিনি কাজ করেছেন। এজন্য তার কোনো কোনো কাজ নিয়ে বিতর্ক হয়েছে, দলের সকলে তার সাথে একমত হননি। কিন্তু তিনি দলের বাইরে অনেক মানুষের সমর্থন পেয়েছেন। আবার অনেকসময় নাগরিক সমাজের কোনো কোনো ভূমিকার সাথে তার ভূমিকার মিল হয়নি। তবে তিনি যেহেতু রাজনীতিবিদ, যখন তিনি বুঝেছেন যে এটা বেশীদূর টানা করা যাবে না, তখন সেটা বাদ দিয়েছেন। কিন্তু সবসময় জনস্বার্থকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন।’
আওয়ামী লীগের নেতারা বলেছেন মহিউদ্দিন চৌধুরীর সমসাময়িক অনেক রাজনীতিবিদ মন্ত্রীত্ব কিংবা দলের সিনিয়র নেতার পদ পেলেও তিনি সবসময় নিজেকে চট্টগ্রামের রাজনীতির সাথেই যুক্ত রাখতে চেয়েছিলেন।
কুলখানিতে পদদলিত হয়ে নিহত ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই ধর্মাবলম্বী: সদ্য প্রয়াত চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিনের কুলখানিতে পদদলিত হয়ে নিহত ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই হিন্দু ধর্মালম্বী বলে জানা গেছে। এছাড়াও আহত হয়েছে আরো অর্ধ-শতাধিক।
প্রতক্ষ্যদর্শী সূত্রে জানা যায়, নগরীর রিমা কমিউনিটি সেন্টারে হিন্দু-বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীসহ অমুসলিমদের জন্য আলাদাভাবে মেজবানের ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে দুপুর ১টার পর প্রচণ্ড ভিড় তৈরি হয়। এক পর্যায়ে হুড়োহুড়ি করে ঢোকার সময় পদদলিত হয়ে কৃষ্ণপদ, সুজিত দাশ, শুভাশিষ তালুকদার, ঝন্টু, রবিন দাশ, উজ্জ্বল চৌধুরী, দুলাল, কনক দাশ, সুমন দাশ ও আশিষ বড়ুয়াসহ ১০ জন নিহত হয়। সোমবার (১৮ ডিসেম্বর) দুপুরে এ ঘটনা ঘটে।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, প্রয়াত মহিউদ্দিন চৌধুরীর পরিবারের পক্ষ থেকে তার মৃত্যুতে আজ চট্টগ্রামের ১৪টি কমিউনিটি সেন্টারে কুলখানি ও মেজবানের আয়োজন করা হয়।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম নগরীর ম্যাক্স হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৩টার দিকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। শুক্রবার দুই দফা জানাজা শেষে নগরীর চশমা হিল এলাকার কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।